সরসিজ আলীমের ৫টি বই

সরসিজ আলীমের ৫টি বই
বই কিনুন। বন্ধুদের বলুন। ভালো থাকুন।

বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১০

রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০১০

কাব্যভাতি: ফেসবুকের কবিবন্ধুদের তালিকা

কাব্যভাতি: ফেসবুকের কবিবন্ধুদের তালিকা: "বন্ধুরা, ফেসবুকের ‍‍‍ ' vone jaha vone, sorosij alim & heera taheera' এই ৩টি একাউন্ট থেকে একাউন্টের বন্ধু তালিকা হতে কবিবন্ধুদের অনুসন্ধান..."

শনিবার, ১০ জুলাই, ২০১০

বিজ্ঞাপন দিন











সুধী
ভনে একটি গ্রন্থ বিষয়ক বিশেষ ভাবনার কাগজ। গ্রন্থ বিষয়ক নানান খবরাখবরের কাগজ। প্রিয় লেখকের প্রিয় বই নিয়ে পাঠকের ভাবনা, বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া, গ্রন্থালোচনা, আড্ডা, ম্যাগসংবাদ, অনুবাদ, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভনে নির্বাচিত প্রিয় বইয়ের তালিকা, আর লেখক নির্বাচিত প্রিয় বইয়ের তালিকা তো থাকছেই। সময়ে সময়ে আরো নতুন নতুন বিষয় যোগ হবে আশা করছি। কাগজটি সেপ্টেম্বর ২০১০ হতে প্রতিমাসে নিয়মিত বের হচ্ছে।

মহোদয় 
ভনে প্রকাশে আপনার ও আপনার প্রতিষ্ঠানের সহায়তা কামনা করি। কাগজটির সাফল্য এবং সমৃদ্ধির সাথে যুক্ত থাকুক আপনার প্রতিষ্ঠান।

অতএব 
বিজ্ঞাপন দিন। ভনে প্রকাশে সহায়তা করুন। ইতিহাসের সঙ্গি হোন।

বিবরণ বিজ্ঞাপনের হার
পূর্ণ ব্যানার (প্রথম পৃষ্ঠা) ৫০০০ টাকা
পূর্ণ ব্যানার (শেষ পৃষ্ঠা) ৫০০০ টাকা
ভিতরে পূর্ণ ব্যানার ৬০০০ টাকা
ভিতরে ব্যানারের অর্ধেক ৩০০০ টাকা
প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় ব্যানারে ২”-২.৫” ১৫০০ টাকা
ভিতরের ব্যানারে ২”-২.৫” ১০০০ টাকা
কলাম-ইঞ্চি (প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা) ১২৫০ টাকা
কলাম-ইঞ্চি (ভিতরে যে কোন) ১০০০ টাকা

বিনীত

সম্পাদক,
ভনে

১৮৩/১/এ দক্ষিণ পীরেরবাগ মিরপুর ঢাকা বাংলাদেশ।
ফোন: ০১৯১৬৪৫৬৮৭২।

E-mail: vone2008@live.com, sorosijalim@gmail.com, voneprokash@gmail.com 

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০০৯

ভনে প্রথম সংখ্যা । আগষ্ট ২০০৯।

নিয়মিত বিভাগ:
সোনারোদ্দুর:প্রবন্ধ,গল্প,কবিতা বিভাগ।
শুদ্ধ চিন্তার শুদ্ধ পাঠ:গ্রন্থালোচনা বিভাগ।
সেঁজবাতি:প্রিয় লেখকের প্রিয় বই বিভাগ।
আমাদের ক্ষেত আমাদের খামার:গ্রন্থপরিচিতি বিভাগ।
শিশিরের শব্দ:সমকালীন গ্রন্থ তালিকা বিভাগ।
ম্যাগসংবাদ:ম্যাগসংবাদ বিভাগ।
অপরিকল্পিত পর্ব:আড্ডা বিভাগ।
সাদাকালো পৃষ্ঠা:চিঠিপত্র বিভাগ।
অনুবাদ:অনুবাদ বিভাগ।

ভনে পরিবার

সম্পাদক: সরসিজ আলীম
বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন
: শিশির আজম, আলোড়ন খীসা
: আলতাফ শেহাব
: চারুপিন্টু
: মনি মহম্মদ





ম্যাগসংবাদ

সময়ের কয়েকটি ম্যাগের প্রাপ্তিষ্বীকার


প্রনাস
প্রনাস,একটি প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ প্রকাশনা।
প্রথম সংখ্যাটি ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক; মৃন্ময় মনির। বাড়ি-৪৮, রোড-৩, ব্লক-ই, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ থেকে প্রকাশিত। বিপ্লবী নেতা ডাঃ মিজানুর রহমান টুটু-র স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত পাতায় নেতার ছবিটি জলছাপে আঁকা হয়েছে। ছবিটি দেখে একটু থমকে যেতেই হয়। মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তাই সম্পাদকীয় উচ্চারণের সাথে একসুরে উচ্চারণ করতেই হয়: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস রুখতেই হবে।
প্রনাস-এ কোটচাঁদপুরের নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন মোহাঃ মুজিবর রহমান, রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন মুহম্মদ আব্দুল মালেক বিশ্বাস। সাহিত্যালোচনা করেছেন বিমল ভৌমিক। বিজ্ঞান বিষয়ের লেখাটি সম্পাদনা করেছেন রওশন আলী। প্রবন্ধ লিখেছেন নিমাই চন্দ্র দে, বেনজীন খান, শামসুজ্জামান তপন। প্রতিবেদন লিখেছেন শাজান শীলন, শরীফুজ্জামান আগা খান, মশিয়ার রহমান। গল্প লিখেছেন আক্তারুজ্জামান রকিব। কবিতা লিখেছেন পাবলো শাহী, শামীম নওরোজ, শিশির আজম, পারভিন শশী, বাপ্পী জোয়ার্দ্দার, মুকুল মল্লী, মিতুল সাইফ, আরেফিন অনু, অঞ্জন মেহেদী, জোসে প্রাপন, রশিদুল ইসলাম রশিদ, রিপন মেহ্‌মুদ, নজরুল ইসলাম, এস.পারভেজ। দুটি গান লিখেছেন সরসিজ আলীম।

অগ্রবীজ
সাহিত্য ও চিন্তার কাগজ।
দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ৫১০৪ ওয়ালেরা ড্রাইভ, গ্রান্ড প্রেইরী, টেক্সাস, ৭৫০৫২, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিসেম্বর ২০০৮-এ প্রকাশিত। বর্তমান সংখ্যার সম্পাদক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। ৩৬০ পৃষ্ঠার স্বাস্থ্যবান কাগজটিতে প্রবন্ধ লিখেছেন সুমন গুণ, আয়শা ঝর্ণা, হিন্দোল ভট্টাচার্য, গৌতম ঘোষদস্তিদার, অনির্বাণ রায়, গৌতম বসু, ইফ্‌ফাত আরেফিন তন্বী, আফসার আহমদ, তপন বাগচী, বিতান পুরকায়স্থ, বাবু রহমান, শুভাশিস চক্রবর্তী, একরাম আলি, রবিশংকর বল, কামরুল হাসান, অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, মামুন রশিদ, কমলেশ পাল, কুমার চক্রবর্তী, আদিত্য কবির, ও রাঘব বন্দোপাধ্যায়। কবিতা লিখেছেন কাজল চক্রবর্তী, সুমন ঘোষ, আলতাফ হোসেন, মাসুদ খান, হিন্দোল ভট্টাচার্য, মিতুল দত্ত, শুভ্র বন্দোপাধ্যায়, তাপস গায়েন, প্রসূন বন্দোপাধ্যায়, রোহণ কুদ্দুস, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, অনুপম মুখোপাধ্যায়, রাহুল পুরকায়স্থ, চিরঞ্জীব বসু, সুমন গুণ, রুদ্র শায়ক, কামরুল হাসান, জুয়েল মাজহার, খালেদ হামিদী, ইফ্‌ফাত আরেফিন তন্বী, শরীফ শাহরিয়ার, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, সরকার আমিন, রিয়াদ চৌধুরী, নভেরা হোসেন, অনির্বাণ দাস, বিজয় সিংহ, রাতুল চন্দরায়, চয়ন খায়রুল হাবিব, সিদ্ধার্থ টিপু, কাজী জেসিন, অনীক রুদ্র, বর্ণালী পাইন, পাবলো শাহি, ওবায়েদ আকাশ, অদিতি ফাল্গুনী, আদিত্য কবির, সরসিজ আলীম, পিয়শ্রী মারিয়া হোম, অভীক মজুমদার, মুজিব ইরম, সন্দীপন চক্রবর্তী, চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ, সুবিমল চক্রবর্তী, ও অংকুর সাহা। গল্প লিখেছেন রাশিদা সুলতানা। চিঠি লিখেছেন চিরঞ্জীব দাশগুপ্ত। কবি শহীদ কাদরী-কে নিয়ে ক্রোড়পত্র আয়োজনে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সাদ কামালী। শহীদ কাদরী গদ্য লিখেছেন কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে। শহীদ কাদরীকে নিয়ে লিখেছেন মফিদুল হক, মাহমুদ আল জামান, হাসান ফেরদৌস, আনু হোসেন, সৌম্য দাশগুপ্ত, কামরুল ইসলাম, ওবায়েদ আকাশ, মামুন মোস্তফা, মুহম্মদ সবুর, মুহম্মদ জুবায়ের, মুজিব ইরম এবং আদনান সৈয়দ। অগ্রবীজের সর্বশেষাংশে রাখা হয়েছে লেখক পরিচিতিও।

ঘুড়ি
শিল্প সাহিত্য ও চিন্তার ছোটকাগজ।
সংখ্যা ৫, নতুন সি টাইপ, ব্লক ৪ (৩য় তলা/চ) বন্দর আ/এ, অভয়মিত্র ঘাট, চট্টগ্রাম থেকে ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ প্রকাশিত। সম্পাদক: আসমা বীথি। এ সংখ্যা জুড়ে রয়েছে সমালোচনা সাহিত্য ও নেপালের গল্পের ইংরেজী থেকে অনুবাদ। প্রসঙ্গ: সমালোচনা বিভাগে লিখেছেন বিপ্লব বালা, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, চঞ্চল আশরাফ, ফজলুল কাবেরী। পুর্নপাঠ বিভাগে নির্বাচন করা হয়েছে বুদ্ধদেব বসুর কোন সমালোচকের প্রতি কবিতাটি এবং আবুল ফজলের সমালোচনা লেখাটি। নির্বাচিত পাঠ পর্যালোচনা বিভাগে লেখকগণ নিজেদের পাঠ মূল্যায়ণ করেছেন, তারা হলেন: পাভেল পার্থ, সাইদুল ইসলাম, সৈকত দে। গল্প লিখেছেন আহমেদ মুনির, প্রবীর পাল। প্রতিবেশী গল্প : নেপাল বিভাগে মাইকেল জেম্‌স হাট-এর লেখা থেকে অনুবাদ করেছেন আমিনুল এহসান। বিজয় মাল্লা-র গল্প থেকে অনুবাদ করেছেন মো. সাইফুর রহমান, শঙ্কর লামিচান থেকে মাহমুদ আলম সৈকত, মনু ব্রজকি থেকে রেজাউল করিম সুমন, পরশু প্রধান থেকে আহমেদ আশরাফি, কিশোর পাহাড়ি থেকে মাহমুদ আলম সৈকত। কবিতা লিখেছেন শুভাশিস সিনহা, মুয়িন পার্ভেজ, সোহেল হাসান গালিব, সাইদুল ইসলাম, চন্দন চৌধুরী, নায়েম লিটু, ফুয়াদ হাসান, অঞ্জন সরকার জিমি, আফরোজা সোমা, স্বরূপ সুপান্থ, পিয়াস মজিদ, নওশাদ জামিল, লুবনা চর্যা, মিঠুন রাকসাম, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, প্রান্ত পলাশ, পরাগ রিছিল, আসমা বীথি। এবং কষ্টকর দীর্ঘ কবিতাটি লিখেছেন পলাশ দত্ত।


আমাদের ক্ষেত আমাদের খামার

প্রত্যেক লেখক বা পাঠক তার পঠন-পাঠন থেকে জীবনব্যাপী যা-কিছু সংগ্রহ করেন, অনেক ক্ষেত্রেই তা পাঠ-নোট হিসেবে ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। এমনই এক পাঠ-নোট কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের ডায়েরি থেকে নেয়া হলো।

ডায়েরি থেকে

জাকির তালুকদার


গৌতম ভদ্রের ‘ঈমান ও নিশান’ বই থেকে কিছু জিনিস টুকলিটাই করে রাখা হোক। বইটি বিভ্রান্তিকর এবং এলোমেলো। তবে কিছু শব্দের ব্যবহার ও তথ্য গুরুত্বপূর্ণ।
• নজরটান ; আন্ডারলাইন অর্থে।
• থাকবন্দি ; স্তর বোঝাতে। সামাজিক শ্রেণীস্তর।
• ‘ইতিহাস সকল দেশে সমান হবেই, এ কুসংস্কার বর্জন না করলেই নয়।’ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
• বিনয়ভূষণ চৌধুরী লিখেছেন এইদেশে কৃষক আন্দোলনে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে। তার মতে, নানা সময়ে নানা আন্দোলনে ধর্মের ভূমিকা পৃথক পৃথক। ধর্মের প্রভাবের দিক থেকে বিচার করলে একশ্রেণীর আন্দোলনে ধর্মীয় প্রভাব সীমিত। সেখানে তার ‘ভূমিকা প্রধানত সংহতি রক্ষায়’। সেখানে বিদ্রোহের ‘যৌথ সিদ্ধান্ত’ ধর্মবিশ্বাসের সাথে যুক্ত। এখানে বিদ্রোহের বিশ্বাসের উত্স ধর্ম। গৌতম ভদ্র জোর দিয়ে বলেছেন যে, নিম্নকোটির মানুষের জোয়ারের উত্স আসে দুটি ক্ষেত্র থেকে- ১. সমপ্রদায় হিসাবে সংহতির কেন্দ্র। ২. নিজের ঈমানের জোর, জীবনচর্চায় আর নৈষ্ঠিক ধর্মচর্চায় নিজেকে অপরের চাইতে সঠিক পথের রাহি হবার বিশ্বাস। ( রাহি ; সম্মুখবর্তী।)
• তীতুমীর ও তার অনুসারীরা দাড়ি রাখত, মাথা কামাত আর কাছাখোলা ধুতি (তহবন্দ) পরত। জমিদারের লোকেরা তাদের টিটকিরি দিয়ে বলত ‘নেড়ে আর দেড়ে’। কাছা দিয়ে ধুতি না পরায় বলত যে ওদের সবার অন্ডকোষ বড় হয়ে গেছে বলে ধুতিতে কাছা দেয় না।
• নিরঞ্জন শব্দের অর্থ যাহার অঞ্জন বা কালিমা নাই। ‘নিরঞ্জনের’ ধারণা বৌদ্ধ সহজিয়া মতে পাওয়া যায়। নির্গুণ সমপ্রদায়ের সাধকরাও নিরঞ্জনের উপাসক। নাথপন্থিদের শিবও নিরঞ্জন। ধর্মঠাকুরের আরেকটা নাম নিরঞ্জন। বাংলার লৌকিক পীরবাদে নিরঞ্জন আর আল্লা অভিন্ন। নাথপন্থী আর পীরবাদীদের মতে হঠযোগী সাধনার মাধ্যমে নিরঞ্জনকে পাওয়া যায়।
• ১৮৫৭ সালের ৭ জুন। এলাহাবাদের চৈল এলাকার ছোট গ্রাম বারওয়ারি। জমিদার নায়েব বখ্‌শ ও এলাকার অধিবাসীরা জোট বেঁধে রেলপথ তৈরিতে নিযুক্ত ইংরেজ কর্মচারীদের আক্রমণ করে তাদের বাসস্থান পুড়িয়ে দিল। ইংরেজরা জলের টাঙ্কির উপরে উঠে আশ্রয় নিল। তাদের অবরোধ করে বসে রইল বিদ্রোহীরা। ইংরেজরা জীবনরক্ষায় কাকুতি মিনতি করায় বিদ্রোহীরা জানাল যে টাকা দিলে ইংরেজদের হত্যা করা হবে না। ইংরেজরা টাকা দিতে এলে বিদ্রোহীরা আদেশ করল ঐ টাকাকে দুইভাগে ভাগ করতে। কারণ তাদের মধ্যে একদল হিন্দু আরেকদল মুসলমান। তারা দুই সারিতে লাইনবন্দি দাড়ালে ইংরেজরা প্রত্যেক সারিকে পাঁচশ টাকা করে দিল।
গ্রামবাসীরা একজোট হয়ে শত্রুকে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু টাকা ভাগাভাগির সময তারা আবার হিন্দু-মুসলমান সত্তায় ফিরে এসে নিজ নিজ বখরা বুঝে নিয়েছিল।
 কুফর-এর অর্থ হলো কোন বস্তুকে অন্য বস্তু দিয়ে ঢেকে ফেলা। কাফের মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখে। কৃষক মাটি দিয়ে রীজ ঢেকে ফেলে বলে আরবিতে কৃষককেও কাফের বলে ডাকা হয়।
 ওরস-এর আক্ষরিক অর্থ বিবাহ অনুষ্ঠান। এখন পীরের মাজারে বার্ষিক অনুষ্ঠান।
 খুদকস্তা ; নিজ বাসস্থানের জমি যে কৃষক পুরুষানুক্রমে চাষ করে। খুশিমতো জমিদার এদের উচ্ছেদ করতে পারে না।
 কুতুব ; আক্ষরিক অর্থে ধ্রুবতারা। সর্ব্বোচ্চ সুফী সাধক। এক জায়গায় একজনই কুতুব থাকতে পারেন।
 চেরাগি ; পীরের দরগায় চেরাগ বা প্রদীপ জ্বালানোর জন্য নজর।
 নানকার ; নান অর্থ রুটি। দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে খোরপোষ বাবদ ভৃত্যস্থানীয় প্রজাকে প্রদত্ত জমি।
 পীর ; আক্ষরিক অর্থে স্থবির, বড়।
 পাকিহস্তা ; যে কৃষক এক জমিদারের গ্রামে বাস করে অথচ অন্য জমিদারের অধিকারভূক্ত গ্রামে চাষ করে ও খাজনা দেয়।
 ফেকাহ ; আভিধানিক অর্থ বোধশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও তথ্য।
 বুথশিকন ; সৃষ্টি বিনষ্টকারী।
 ভকিল ; প্রতিনিধি।
 মাদারি ; বিশেষ শ্রেণীর মুসলমান ফকির। কানপুরের সন্নিহিত মাকনপুরের জিন্দাশাহ মাদারের শিষ্যবৃন্দ। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই শ্রেণীর ফকিররা সাধনা করে। দ্রুত উচ্চারণে ‘দম মাদার’ শব্দ বলে থাকে। তাই এদের নাম মাদার ফকির।



সেঁজবাতি


দ্য অন্‌ডারার: পড়তে পড়তে মুগ্ধতা জড়ায়

চন্দন চৌধুরী

When he left us after three days we did not feel that a guest had departed but rather that one of us was still out in the garden and had not yet come in.
ঠিক এমনই, একটা বই পড়ার পর যদি মনে হয় বইটি আমাদের ছেড়ে যায়নি সেখানেই হয়তো বইটির সফলতা। কাহ্‌লিল জিবরানের অন্‌ডারার পড়তে পড়তে পরতে পরতে হারাচ্ছিলাম মুগ্ধতায়। মনে হচ্ছিল মুগ্ধতার বৃষ্টি হচ্ছে আমার ভেতরে। ছোট ছোট গল্পের সে-কী দুরন্ত ঢেউ! আমার ধ্যানের নদীতে ছলাৎ ছলাৎ হাসছিল।আর আমি দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতি ঢেউয়ে এক-একটি ফুল, এক-একটি ভাবনার জন্ম। সেই ছোট ছোট বিস্ময়গুলো আমি কুড়িয়ে নিলাম।
গল্পগুলো খুবই ছোট। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের গল্পকে অনুগল্প হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। আবার চোঙাগল্প বলা যায়। গল্পগুলো দৃষ্টান্তমূলক এবং শিক্ষনীয়। দৃষ্টান্তমূলক বলতে মানুষের জীবনে ঘটে যেতে পারে। আমাদের বাড়িতে সচরাচর অতিথি আসে, কিন্তু সে যদি হয় নতুন আগন্তুক! তবে সে চলে যাবার পর আমরা ভুলে যাই! সে কীভাবে মনের ভেতর প্রতিচ্ছবি রেখে যায়! কাহ্‌লিল জিবরান বলেন, সে হয়তো পাশের বাগানেই আছে। এ বই থেকে অসংখ্য বিষয় শিক্ষনীয়। যেমন সুন্দর দেখেই মুগ্ধ হতে হয় না। হয়তো কদর্য নিজেই সৌন্দর্যের পোষাক পরে আমাদের চোখকে ধোঁকা দিচ্ছে।
ছোট দেখতে হলেও, ছোট প্রাণী অনেক সময় বড় প্রাণীর চেয়ে বেশী একই কাজ ভালোভাবে করতে পারে।
খুব সাধারণ ঘটনা যে সাধারণ নয়, এর সঙ্গে যে অনেক কিছু জড়িত থাকে তা জিবরান এভাবে তুলে ধরেন:
The hyena spoke and said,`How goes the day with you, sir?’
And the crocodile answered saing,`It goes body with me. Sometimes in my pain and sorrow I weep, and then the creatures always say,`They are but crocodile tears.’ And this wounds me beyond all felling.’
তেমনি হায়েনা যখন হাসে তখনও মানুষ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে- এ আর তেমন কি, হায়েনার হাসি!
প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভালোবাসার মধ্যে কোনটি ভালো! জিবরান এখানে খুব সরলভাবে বলেন, আমরা যে আমাদের সহ্যক্ষমতা দিয়ে অসম্ভবকে সহ্য করি এখানে ভালোবাসা যতটা থাকে তাকেই মানুষ ভুলবশত সুখ বলে ধরে নেয়।
কাহলিল জিবরান এই বইটি প্রশ্নের মতো করে উত্তর বলে দেয়। যেমন-
ক. একজন খ্রিস্টান বিশপ ভালো নাকি একজন অখ্রিস্টান মহিলা ভালো। এখানে গীর্জায় আগুন লাগলে দেখা যায় মহিলাটি বেঁচে গেছেন কিন্তু বিশপ খাদ্য হয়ে গেছেন আগুনের।
খ. ‘নবী এবং শিশু’ গল্পে তিনি বলতে চান আমরা হয়তো কারো না কারো তত্ত্বাবধানে থাকি। দেখা যাচ্ছে শিশুটিকে তার পরিচায়িকা খুঁজছেন আর উপর থেকে ডাক আসছে নবীর।
গ. ‘সন্ন্যাসী ও পশুরা’ গল্প থেকে অনুমান করা সম্ভব হয়- যে আমাদের ভালোবাসার শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি কি ভালোবাসা বুঝতে পারেন! একজন সন্ন্যাসী কী করে বুঝবেন ভালোবাসার মহাত্ম!
ঘ. আমাদের চারিপাশেই দেখা যায়- এই ব্রিজের নির্মাণকারী অমুক। প্রকৃতপক্ষে নির্মাতা কে? ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একটা গাধা আরেকটা গাধাকে বলছিল, তোমার মনে আছে আমরা এই ব্রিজ নির্মাণের সময় পাহাড় থেকে পাথর বয়ে এনেছিলাম অথচ লেখা- ব্রিজটি নির্মাণ করেছেন রাজা অমুক!
আসলে ব্রিজের নির্মাতা কে? গাধা না রাজা?
ঙ. একটি ঝিনুক অন্য একটি ঝিনুককে তার ভেতরের দুঃখানুভূতির কথা বলে। অন্য ঝিনুকটি হাসে। কিন্তু সে কি জানে এ দুঃখ মুক্তোজন্মের দুঃখ!
এমনিভাবে বায়ান্নোটি গল্পে কাহলিল জিবরান হরেক রকম শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার ভাষা বর্ণনা অসম্ভব স্রোতল গীতময়। তার বর্ণনার মেজাজ বাতাসে মাঠে শস্যক্ষেতে দোল খাওয়ার মতো। দু’ একটি গল্প পড়ে নিলে তবে বিষয়টি আরো পরিপূর্ণ হবে:
‘‘ শহরের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছিল আর শহরের সমস্ত কুকুর চাঁদের দিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছিল। শুধু একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল না। সে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, স্তব্ধতাকে নিদ্রা থেকে জাগিও না, তোমাদের ঘেউ ঘেউয়ে চাঁদ নেমে আসবে না।
তখন সব কুকুর ঘেউ ঘেউ বন্ধ করল, নেমে এলো ভীতিকর স্তব্ধতা। আর যে কুকুরটি অন্যদের ঘেউ ঘেউ করার জন্য নিষেধ করছিল, রাত্রির স্তব্ধতাকে ভাঙার জন্য সে-ই সারারাত ঘেউ ঘেউ করল।” [পূর্ণচন্দ্র]
আরেকটি ক্ষুদ্র গল্প পড়া যাক:
‘‘ এক লোকের বাগানে অনেক ডালিম গাছ ছিল। অনেক হেমন্তে রূপালি ট্রেতে ডালিম সাজিয়ে সে তার বাড়ির সামনে রেখে দিত এবং ট্রেতে এক টুকরো কাগজে সে লিখে রাখতো- আপনাকে অভিবাদন, ইচ্ছে হলে একটি তুলে নিন।
কিন্তু লোকজন পাশ কাটিয়ে চলে যেত, কেউ একটি ফলও তুলে নিতো না। লোকটা ভাবলো এবং এক হেমন্তে রূপালি ট্রেতে ডালিম সাজিয়ে একটা বড় সাইনবোর্ড দিল: এখানে সবচে’ ভালো ডালিম পাওয়া যায়, তবে অন্য যে কোনো ডালিমের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করি।
দেখা গেল, চারপাশের পুরুষ মহিলা ডালিম কেনার জন্য ভিড় জমিয়েছে।” [ডালিম]
গল্পগুলো জীবনের ভেতর থেকে নতুন পাঁপড়িকে উন্মোচিত করে। মানুষ কি একজন স্রষ্টাকে বেশি ভয় পায় নাকি বহু স্রষ্টাকে! কিংবা মানুষের অভিশাপ কতটা কাজ করে! কুসংস্কারের দেয়ালে তিনি লেপ্টে দিয়েছেন আলোকের হাসি। কাহলিল জিবরানের সবচে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো কঠিন সব বিষয়কে তিনি অনন্য সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তোলেন। তবে সেখানে শিল্পের ঘাটতি থাকে না, থাকে না- লেখা না হয়ে ওঠার বিষয়গুলো। তার গদ্যভাষাটি অপূর্ব, যা দ্রুত পাঠককে আকৃষ্ট করে। দ্য অনডারারের গল্পগুলো তার রচিত অসাধারণ সৃষ্টিগুলোর অন্যতম। The dancer গল্পে তিনি লিখেছেন:
`The philosopher’s soul dwells in his head, the poet’s soul in his heart; the singers soul lingers about his throat, but the soul of the dancer abicher in all her body.”
ঠিক তাই, এই বইয়ের গল্পগুলোও প্রতিটি আলাদা এক-একটি আত্মা। এবং বইপির সারা শরীরেই আত্মা। আর সেগুলো ছড়ায় মুগ্ধতার আলোক। সুতরাং বইটিকে যথার্থ আলোচনা করতে হলে প্রতিটি গল্পকেই আলাদা পাঠ জরুরি। দ্য অনডারারে সত্যিই এক যাযবর ভবঘুরের কথা, যে-গুলো এক-একটি আত্মার প্রতিফলন।

একটি গল্পের সরল পোস্টমর্টেম
সুখ-দুঃখ আমাদের জীবনে বোধহয় সবচে বেশি রেখাপাত করে। সুখ-দুঃখ মিলেই জীবন। তবে সুখাকাঙক্ষী মানুষ দুঃখ চায় না, তারা সুখের সবুজে ডুব দিয়ে থাকতে চায়। তারা হয়তো দুঃখটাকেই উপলব্ধি করে মাত্র। আবার হয়তো না। অন্যদিকে দুঃখভোগী মানুষ দুঃখটাকেই প্রচণ্ডভাবে উপলব্ধি করে এবং সে দুঃখে জর্জরিত থাকে। তবে দুঃখে ডুব দেয়া মানুষ আনন্দের বর্ণিল নদীতে স্নান করতে চায়। তারা চায় না দুঃখটা তাদের মধ্যে থাকুক। বৌদ্ধধর্মের প্রবক্তা বুদ্ধদেব জগতের দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য নির্বাণ লাভ করতে চাইলেন। কামিনী রায় কাঁদতে নিষেধ করলেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সুখী মানুষ কি সুখের সাথে দুঃখটাকে প্রকৃতপক্ষে দেখতে পায় কিংবা দুঃখী মানুষ সুখটাকে? কাহলিল জিবরানের The two hunters গল্পটির কিয়দংশ পড়া যাক:
`Upon a day in may, Joy and sorrow met beside a lake. They greeted one another, and sat down near the quite waters and conversed...
Now there passed by on the other side of the lake twe hunters, and as they looked across the water one of them said,`I wonder who are those two persons?” And other said,` Did you say two? I see only one.”
The first hunter said,`But there are two.” and the second said,` There is only one that I can see, and the reflection in the lake is only one.”
এভাবে একজন দুটি ছায়া দুটি মানুষ, অন্যজন একটি মানুষ এবং একটিমাত্র ছায়া দেখতে পেল। আনন্দ প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর মাঝে অরণ্যের দিবারাত্রির সঙ্গীতের মতো ছড়িয়ে আছে। সে জাদু জানে, জানে সবাইকে মোহিত করে রাখতে। তার আছে অপূর্ব অসাধারণ সেই ক্ষমতা। আমরা যখন একজন মানুষের কাছে তার কুশল জিজ্ঞেস করি মানুষটি কিন্তু তার মন্দত্ব সম্পর্কে তেমন কিছু বলে না। সে বলে, আছি একপ্রকার, কেটে যাচ্ছে... এইসব বলে সে কিন্তু তার দুঃখের কথা বাদ দিয়ে সুখের কাহিনীই বলে। অন্যদিকে সুখী মানুষটি বলে আমি ভালো আছি। সুখী মানুষটি তার সুখ সম্পর্কে অবগত। আর সে জানে না অন্য যে মানুষটি তাকে সুখের গল্প শোনাচ্ছে সে সুখী নয়। কিন্তু অসুখী মানুষটি জানে সুখ কেমন, তাই সে দুঃখ সুখ দু’টোকেই বুঝতে পারে।
গল্পটিকে অন্যভাবে দেখলে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে প্রতীয়মান হবে- জগতের সবকিছুতে সুখ দুঃখ বিরাজিত। কেউ যদি শুধু একটিতে নিপতিত থাকে তবে সে একটি জিনিসে একটিকেই সুখ অথবা দুঃখকে দেখতে পাবে। আর যদি সে সুখ-দুঃখ উভয়কেই দেখতে চায় তবে তাও দেখবে। কাহলিল জিবরান হয়তো প্রথম ধারণা থেকে এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধারণাটির ওপর নজর দিয়ে গল্পটি লিখেছেন। কেউ হয়তো কোনো বিষয় থেকে দুঃখটাকে কিংবা সুখটাকে খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয়। আর এভাবেই মানুষের মধ্যে অস্বচ্ছ ধারণার জন্ম হয়তো। গল্পটির শেষ দুটি লাইন-
‘‘ And even to this day one hunter says that the other sees double; while the other says,``My friend is somewhat blind.”
হয়তো কারো চোখ থাকতেও সে অন্ধ। হয়তো সে একসাথে দু’টিকে ধারণও করতে পারে না কিংবা ধারণ করার ক্ষমতা তার মধ্যে নেই।






শেকড় পোড়া গন্ধপথ

হুমায়ূন আফতাব


প্রান্তের ভিতর দিয়ে যেন ঢুকে যায় ভাবনার শেকড়
নীরবে রোমাঞ্চিত করে তোলে অদৃশ্য অবয়ব!
লুকিয়ে লুকিয়ে উপভোগ করি অস্তিত্বের সর্বনাশ;
কেমন করে ভাসালে আমায় তোমার অথৈ জলে
তোমার দেয়ালে কতকাল হবে মেঘের বীর্যপাত।
পুড়ে পুড়ে পোড়া পাথর কেমন করে ঢুকবে বলো
তোমার স্রোতের সরু পথে।

কেমন করে ডেকে ডেকে বারবার তুমি বলে যাও
আমার সর্বনাশের শেষ দুপুরের গল্প,
মাতাল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমি ঢুকে যাই
তোমার শেকড় পোড়া গন্ধপথে।









অনুবাদ: ভিন্নভাষার সাহিত্য

কাহ্‌লিল জিবরানের চিঠি
আত্মপ্রতিকৃতি
ভাষান্তরঃ আলতাফ শেহাব



কাহ্‌লিল জিবরান(১৮৮৩-১৯৩১), লেবানিজ-আমেরিকান দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, আধ্যাত্মিক কবি ও চিত্রশিল্পী। জিবরানের সর্বাধিক জনপ্রিয় বই The Prophet, আংশিক আত্মজীবনীমূলক ২৬ টি কাব্যিক রচনার সমন্বয়ে রচিত এই বইটি ২০টিরও বেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ১৯২০’র দশকে বইটি সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের গৌরব অর্জন করেছিল। ১৯৬০’র দশকে The Prophet প্রতিশিল্পের পথ প্রদর্শক হয়ে সমনে হাজির হল। জিবরানের বহুমাত্রিক সৃজনশীল কর্মকাণ্ড সে সময় আমেরিকার সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। জিবরান বিশ্বাস করতেন চিন্তা ও যাপনের একটি সুস্থ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন উপায় নিশ্চয় পাওয়া যাবে, যা দ্বারা মানুষ নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।
“ মানুষের হৃদয় সাহায্যের জন্য কাঁদে, মানুষের মন মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। কিন্তু আমরা তাদের কান্না অনুধাবন করতে পারিনা; শুনিওনা, বুঝিওনা। আর যে শোনে এবং বোঝে আমরা তাকে পাগল বলি। তার কাছথেকে পালিয়ে বেড়াই।”

কাহ্‌লিল জিবরান ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি লেবাননের বস্‌রিতে একটি খ্রীস্টান অধ্যুষিত পাহাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। খুব অল্প বয়সে মেধাবী শিশু জিবরান আঁকাআঁকি ও লেখালেখি শুরু করেন। জিবরানের মা কামিলা রাহ্‌মি তার সন্তানদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান, তাদের বাবা ওয়ালনাট বাগানের মালিক কাহ্‌লিল লেবাননেই থেকে যান। জিবরানদের পরিবার প্রথমে বোস্টনে বসবাস শুরু করে, সেখানে তার মা লাইনেন ও ফিতা বিক্রি করে জিবিকা নির্বাহ করতেন। একবছরের মধ্যেই তিনি পর্যাপ্ত টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন যা দিয়ে ছেলে পিটারকে শুকনো মালপত্রের দোকান খুলতে সাহায্য করেছিলেন।

১৮৯৮ সালে বৈরুতের আল-হিকমা কলেজে আরবি সাহিত্যে পড়ালেখা করার উদ্দেশ্যে জিবরান দুই বছরের জন্য লেবাননে ফিরে আসেন। জিবরানের শিল্পীসত্ত্বা বিকশিত হতে থাকল এবং আলোচিত্রী এফ. হল্যান্ড ডে’র সাথে পরিচয় হল। জিবরান তার কছে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে দীক্ষা নিলেন। এরই মধ্যে জিবরান বোস্টন সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করলেন, সেখানে তার সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সাথে যোগাযোগ হল। ২০ বছর বয়সে মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বোন মারিনা পরবর্তীতে তাকে একজন চিত্রশিল্পী ও লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। সারাজীবন জিবরানকে সবচে বেশী সহযোগিতা করেছিলেন ক্যম্ব্রিজের একটি প্রগতিশীল বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেরী হ্যাস্‌কিল। তিনি জিবরানের সকল ইংরেজী বইয়ের সম্পাদনা করতেন এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবেও সহযোগিতা করতেন।

১৯০৪ সালে বোস্টনে জিবরানের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। তার প্রথম বই Al-Musiqa(1905) সঙ্গীত বিষয়ে লেখা। ১৯১২ সালে এই বইয়ের অনুকরণে ছোটগল্প ও উপন্যাসিকার দুইটি সংকলন বের হয়। ১৯০৮ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত অগাস্ট রোডিনের সাথে প্যারিসে চিত্রকলা বিষয়ে পড়ালেখা করেন। ১৯১২ সালে লেখালেখি ও ছবি আঁকার স্বার্থে নিউইয়র্কে স্থায়ী হন, তার বইতে অতিমানবীয় বিষয়াবলী সংশ্লিষ্ট হয়, জিবরানের ছবির মূল বিষয়বস্তু পরষ্পর সংলগ্ন মানুষের নগ্ন শরীরের কোমল রূপ।

জিবরান লেখালেখি শুরু করেছিলেন আরবিতে, আধুনিক আরবি সহিত্যের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি লেবানিজ এবং আরবি ভাষাভাষী লোকজনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে লিখেছিলেন। ১৯১৮ সাল থেকে মূলতঃ ইংরেজীতে লেখা শুরু করেন এবং ১৯২০ ও ১৯৩০ দশকের কবিতার ভাষায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। Alfred Knopf প্রকাশনী হতে প্রকাশিত প্রথম বই The Madman(1918), গল্প ও কবিতার মাঝামাঝি- বাইবেলের ছন্দে লেখা স্বতঃসিদ্ধ প্রবাদ ও নীতিগল্পের একটি ছোটখাটো সংকলন।

জিবরান তার মাতৃভূমি এবং মানবতার জন্য হুমকি শয়তানকে প্রতিহত করার জন্য মহাপুরুষোচিত স্বর ব্যবহার করতেন। আধ্যাত্মিকতা ও সুন্দরের সমন্বয়ে গঠিত তার বিচিত্র এই প্রকাশভঙ্গি পরবর্তীতে ‘জিবরানইজম’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
“আমি আমার নিজের কাছে অচেনা। আমি আমার ঠোঁটকে বলতে শুনি কিন্তু কানের কাছে তা অচেনা ঠেকে। মনে হয় দেখছি, আমারই এক লুকানো সত্ত্বা হাসছে, কাঁদছে, বিচিত্র দুঃখবোধ; এসব কারণে নিজেকে দেখে নিজেই বিমোহিত হই এবং এইবোধরা আমার মনের কাছে ব্যখ্যা চেয়ে প্রশ্ন করে। কিন্তু আমি অজানা, গোপন, কুয়াশা আবৃত নৈঃশব্দের ভেতর চলে যাই।
('The Poet' থেকে)
১৯২০ সালে জিবরান আরব লেখকদের জন্য ‘Aribitah(pen bond)’ নামে একটি সংগঠন গঠন করার মাধ্যমে প্রাচীন রক্ষণশীল আরবি সাহিত্যে বিপ্লবের হাতকে শক্তিশালী করেন। নতুন চিন্তাকে প্রকাশ করার শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে আর্ভিভূত, নিউইয়র্কে প্রকাশিত প্রথম আরবি দৈনিক Al Magar; জিবরান এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন।

জিবরান সৃজনশীলতার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিলেন; যদিও তিনি কাব্য সাহিত্যের বিশাল কোন কবি ছিলেননা, গদ্যের মত করে লেখা তার বেশীরভাগ রচনাকে কবিতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়না। নিজস্ব চিত্রকর্মের মাধ্যমে নিজের একটি বইয়ে অলংকরণও করেছিলেন।

অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে পাকস্থলীতে রোগাক্রান্ত হয়ে ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিউইয়র্কে এই মহান দার্শনিক, চিত্রশিল্পী ও কবির জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পর এই মহান শিল্পীকে তার জন্মভূমি লেবাননে সমাধিস্থ করা হয়। পরবর্তীতে সমাধীর পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয় জিবরান মিউজিয়াম। জিবরান তার সকল বইয়ের র্যেয়েলেটি নিজগ্রামের নামে উইল করে যান।
“যখন আত্মারা তাদের
আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়, আমার হৃদয়
দুঃখের অন্ধকারে তলিয়ে যায়।
রাত্রি! আমি তোমারই মত। যখন সকাল আসে
তখন আমার সময় নিঃশেষ হতে থাকে।”

জিবরানের মৃত্যুর প্রায় ২৮ বছর পর ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হলো A Self Portrait (আত্মপ্রতিকৃতি)| জিবরান সারা জীবন বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজনকে বহু চিঠি লিখেছেন। এই বইটি মূলতঃ জিবরানের লেখা সেইসব চিঠির একটি সংকলন। প্রায় সবগুলো চিঠিরই সংক্ষিপ্ত ভূমিকা সংযোজিত আছে; যার ফলে প্রাপকের সাথে লেখকের সম্পর্কের ধরণ, চিঠিটি লেখার সময়কাল ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। চিঠিগুলো পড়ে খুব সহজেই জিবরানের আবেগ ও আকাঙক্ষাকে ছোঁয়া যায়; নিবীড়ভাবে উপলব্ধি করা যায় জিবরান ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গায় কি পরিমান দায়ীত্বশীল ছিলেন।


চিঠি

বস্‌রি থেকে বাবাকে লেখা এই চিঠিখানিতে জিবরান তার দুইবোন মারিনা এবং সুলতানার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাদের কোন এক আত্মীয় জিবরানের বাবাকে লিখেছিলেন, তার দুই মেয়ে খুবই অসুস্থ; বৃদ্ধ তার দুশ্চিনতার কথা ছেলেকে জানিয়েছিলেন। জিবরানের বাবা এই চিঠির তারিখ সম্পর্কে কিছু জানাননি। চিঠিখানি সম্ভবত এপ্রিলের প্রথম দিকে অথবা এপ্রিল ফুল’র দিন লেখা।

বাবাকে জিবরান


বৈরুত,
এপ্রিল, ১৯০৪
প্রিয় বাবা,
অপ্রত্যাশিত একটি সংবাদ পেয়ে গভীর দুঃখ ও দুশ্চিন্তার কথা জনিয়ে লেখা আপনার চিঠিখানি হাতে পেয়েছি। আমিও আপনার মত বেদনা বোধ করছি; কিন্তু এই চিঠি লেখার পেছনে লেখকের উদ্দেশ্য এবং চিঠির কারণ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তারা (ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন) আপনাকে চিঠিতে বলেছে আমার বোনদের একজন জটিল রোগে আক্রান্ত এবং তারা এও বলেছে, তার অসুখটি বড়সড় ব্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত। যে কারণে আমার বোনদের আপনাকে টাকা পাঠাতে সমস্যা হতে পারে। সমপ্রতি এই ভূতুড়ে চিঠির পেছনে আমি একটি কারণ খুঁজে পেয়েছি, চিঠিটি এপ্রিলের প্রথমদিন লেখা হয়েছিল। আমাদের খালামনি এ ধরণের ভদ্র এবং মজার রসিকতা করে অভ্যস্ত। তার ভাষ্যমতে আমাদের বোনদ্বয় গত ছ’মাস ধরে অসুস্থ; এটা কতটুকু সত্য তাতো শুনেই বোঝা যাচ্ছে। গত সাতমাসে মি.রয় আমাকে পাঁচটি চিঠি লিখেছেন, যাতে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আমার দুই বোন মারিনা ও সুলতানা দারুন সুস্থ রয়েছে। তিনি তাদের সত্ চরিত্রের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন, বিশেষ করে সুলতানার মার্জিত ব্যবহার সম্পর্কে বলেছেন; তিনি বলেছেন আমাদের দু’জনের চেহারা, শারিরিক গঠন ও চরিত্রের দারুণ মিল রয়েছে। কথাগুলো আমাকে এমন একজন মানুষ বলেছেন যিনি আমার দেখা সবচে সত্ মানুষ। তিনি এমন একজন মানুষ যিনি এপ্রিল ফুলের ঠাট্টা-তামাশা মারাত্মক ঘৃণা করেন এবং মানুষের হৃদয়ে দুঃখের সঞ্চার করে এমন বানোয়াট বিষয় অপছন্দ করেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি সবকিছু ঠিকঠাক আছে, আপনি আপনার মনকে শান্ত করুন।

আমি এখনও বৈরুতেই আছি। মনে হচ্ছে পুরোমাসটিই ঘরছাড়া থাকতে হবে। সেই আমেরিকান পরিবারকে অগাধ শ্রদ্ধা জানাই যাদের কল্যাণে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি সিরিয়া ও ফিলিস্তিন, যাদের কারণে মিশর এবং সুদান সফর আমার জন্য সহজ হল। যে কারণে আমি বলতে পারছিনা কবে আবার বৈরুত হতে ফিরছি। যাহোক, আমি আমার ব্যাক্তিগত সুবিধার কথা চিন্তা করেই এখানে রয়ে গেছি যা আমাকে এই দেশে থাকতে সাহায্য করবে। আর তারা দু’জনেই আমার ভবিষ্যত্ সম্পর্কে খুব ভাবে। আমার ভবিষ্যৎকে সুন্দর ও সুরক্ষিত করার জন্য কি করা প্রয়োজন এখন আমি তা সন্দেহাতীত আন্তরিকতার সাথে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারি।

আপনাকে যা বলার ছিল প্রায় সবই বলা হয়ে গেছে- আমার সব আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবকে গভীর ভালোবাসা জানাই। আর শ্রদ্ধা জানাই তাদেরকে যারা নিয়মিত আমার খোঁজ করে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি- তিনি যেন আপনাদের সুস্থ রাখেন এবং দীর্ঘায়ু করেন।

আপনার পুত্র
জিবরান







শুদ্ধ চিন্তার শুদ্ধ পাঠ

দেয়ালে লেখা কবিতা: ব্যাঙ্গের মাঝে খোঁচায় বাস্তবতার ধারাল চাকু

আলোড়ন খীসা


প্রথমবার যখন স্বাভাবিক স্থানচ্যুত হয়ে নৈসর্গিক পাথারে জীবন-যাপন করছি তখনই নিউটনের ৩য় সূত্রের মতো কিছু প্রতিক্রিয়ার শেল এসে চোখে মুখে বেধেঁছিল। চক্রাকারে মনে হয়েছিল ভূল করেছি। পরে অভ্যন্তরীণ পাঠে বোঝা গিয়েছিল দ্যূতির লুকানো গভীর তীব্রতা। শিশির আজমের ‘দেয়ালে লেখা কবিতা’ বইটি হাতে পেলে তার প্রচ্ছদের অবয়বটি চোখে যে অনুভূতির সৃষ্টি করে তা হলো স্থুলতা। অনতিদূর থেকে মনে হতে পারে স্থুল চিন্তা-চেতনের লেখা কোন মানব-মানবীর আদিম মুহূর্তে ঠাসা কামসূত্রের বিন্যাস বা কাল্পনিক ভালোবাসার অবমূল্যায়নের বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী। বলা হয়ে থাকে আগে ‘দর্শন’ তারপর গুণবিচার, এক্ষেত্রে তার বইটি কবিতাপত্র হিসেবে চোখের ্লায়ুতন্ত্রের আবেদন জাগাতে অক্ষম। অনন্ত আঁধারেও থাকে বিন্দু বিন্দু আলোর উদগীরণ। তাকে খুঁজে বের করে আনা চায়।
সময়ের স্বর বিভিন্ন। একেক সময়ে সময় একেকভাবে খাঁমছে ধরে। সময়ের এই দূর্দান্ত গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিশির আজম পরিচয় করিয়েছেন পরিবেশ বান্ধব ভাবনার অলৌকিক গতির সাথে। ভ্রমন করার জন্য আকাশপথ-স্থলপথ-জলপথের চাইতে আরেকটি প্রচণ্ড গতিশীল পথ হলো লাগামছাড়া কবিপথ। শিশির আজম তার নির্মিত চিন্তাজাগানিয়া পথে পথে নিয়ে পাঠককে ছেড়ে দিয়েছেন গহীন মজ্জায়। প্রাণীরা হেঁটে যায় শহরের ধাঁধা লাগানো জ্যেতিষ্কমণ্ডলের নিচ দিয়ে গোঙাতে গোঙাতে এবং উপত্যাকার রূপালি আলোয় কেঁদে ওঠে ফালি ফালি ক্রোধের আস্ফালনে। ভাবনার অবশিষ্ট আর্তনাদ জেগে ওঠে নিয়ন আলোয় ।
সমস্যা দেখলেই পালিয়ে বেড়ানো আমাদের মজ্জাগত স্বভাবের একটি। আমরা নিজস্ব সমস্যাই ফেলে দিতে চাই বস্তায় মুখ বেঁধে, অন্যের সমস্যা আমাদের চোখের পৃথক দুটি অংশের কোনটিতে ধরা পড়েনা। ভাববাদ এবং বস্তুবাদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বে আমরা শামিল হতে না পেরে পালিয়ে চরম লাম্পট্য ধারণ করি।
কবি শিশির আজম তার অস্তিত্বে ধারণ করেছেন বহুমাত্রিক অধ্যায়। তারই নিজস্ব গর্ভ থেকে পুরোনো বটিকে শাণিত করেছেন বস্তুবাদের সজোর ধাক্কায়।
দাঁড়িপাল্লায় কি মান মাপা যায়? কবি শিশির অজম মনে হয় মেপেছেন। মেপে দেখলেন মানের অনেক ওজন। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সরিয়ে নিয়েছেন চীনের আমদানীকৃত ছাতা। কিছুটা মান বৃষ্টির সাথে ঝরে পড়ে গেলে তিনি একটু তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তার এই মান তিনি শুধু একান্ত নিজের করেননি। বাঙলাদেশের অথবা দক্ষিণ এশিয়দের মান একত্র করে ঝেড়ে ফেলেছেন নতুন মা ও মাটির সমষ্টিগত আকাঙ্খায়।
‘জগতে আমাদের চেয়ে ভীতু কেউ নেই
জগতে আমরাই জাতিগতভাবে অশুদ্ধ
আমরাই বড় ঠকবাজ
মূর্খতায় আমরাই সেরা।
খিদে পেটে নিয়ে কে আমাদের চেয়ে বেশিক্ষণ
সঙ্গমে লিপ্ত থাকতে পারে ?’
[একজন দক্ষিণ এশীয়র স্বীকারোক্তি/ পৃষ্ঠা- ৪৩]
চারিদিকে যখন অন্ধকারে টইটম্বুর, আবারো দেখা যায় কিছু অন্ধকারের জোনাকি। অন্ধকার গাঢ় বলেই জোনাকি দেখেই ভয়ে পিলে চমকায় নতুন সন্ধিবাজের আশংকায়। মানুষ একে অপরকে বিশ্বাসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়, আবার সেই মানুষকেই বিষাদাগার অবিশ্বাসের হিংসাত্মক কূয়োয় ফেলে। বিশ্বাসের অংশতে স্বপ্ন একটি আপেক্ষিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ সম্পকে গিঁট দেয়া। বিশ্বাসের ভিত্তিতে তার স্বপ্নচূড়া নির্মিত হয়। শিশির আজম সেই বিশ্বাসের ভীত গড়েন চিরায়ত মানব-মুক্তির কল্যাণের পথে। অবিশ্বাসের বিষবীজটি উপড়ে ফেলতে চান সমূলে, সেখানে গেড়ে দেন নিজভূমের একান্ত নিজের সন্তানদের। দৃঢ়কন্ঠে স্বপ্নের বাস্তবায়নে সমস্যার যাতাকল থেকে পিষে আনেন সমাধানের তৃপ্তিকর নির্যাস।
‘যেহেতু সেচকাজের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজেলের দাম
আরেক দফা বাড়ছে
যেহেতু শিশুদের পুষ্টিহীনতা মারাত্মক পর্যায়ে

আমাদের সবার বুকে উচ্চারিত হয় একটি নাম
ফিদেল’
[ফিদেল/পৃষ্ঠা-৪২]
আবার একইভাবে সমাধান করে দেন মেকি স্বপ্নবাজদের হাত থেকে বাঁচতে নাকি শ্রেণীশত্রু খতমের নামে যারা উদ্ভট যুদ্ধের মাধ্যমে সাময়িক ত্রাস সৃষ্টি করছে, তাদের ক্ষণিক স্ফুরিত আলোর মাঝে স্বপ্নের বারুদের গন্ধ শুকতে।
‘শোনা যায়
প্রয়োজনে
ওরা
বন্ধুর বুকে বন্দুক তাক করতে
দ্বিধা করেনা’
[চরমপন্থি/ পৃষ্ঠা-৬১]
চক্রাকার নিয়তি পরিত্রানহীনতার যে বদ্ধ গুমোট গুহা তার ভেতর উর্বরতাটুকু সম্বল করে বোনা বীজটি যাতে সমস্ত বাঁধা ভেঙে গজিয়ে উঠতে পারে তার জন্য ঢেলে দেন প্রাকৃতিক জৈব সার।
একটি ভোর। একটি গ্রামীন নারী। দীপ্র আলোর আভাস তাকে ছুঁড়ে দেয় কর্মযজ্ঞতার আঁতুরঘরের বারান্দায়। লেপ্টে থাকা ছোথ সরানোর আগেই ত্যাড়া বাক্য ছুঁড়ে দেয় তাকে আগুনজ্বলা অমোঘ গুহায়। আদিমতম পেশাটি তাকে জড়িয়ে নেয় আষ্টেপৃষ্টে। স্থায়ী অতিথির সৎকার তার জীবনের চিরন্তনীয় সত্যর একটি। কোনদিন সে খেয়েছে কিনা তার খবর কেউ নেয়নি। অথবা একটি খুকি। নারীর মধ্যবর্তী পর্যায়ের অবিন্যস্ত ঘটনাবলী সাজিয়ে তোলেন বাস্তবতার রূপকল্পে। কিভাবে খুকিটি শোকেসে সাজানো শো-পিচ এ বিবর্তিত হয়।
কবি শিশির আজম এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চান আর চান বলেই জরিনাকে দেখে আনমনে ডুবে যান তার প্রত্যক্ষ সমাধানকল্পে।
‘জরিনা বাসন মাজে, ঝুল ঝাড়ে
আনমনা হয়
জরিনা কাপড় কাঁচে, ঘর পোঁচে
আনমনা হয়

আমি দেখি

আমি দেখি
আর আনমনা হই’
[জরিনা/ পৃষ্ঠা-২৮]
প্রত্যক মানুষেরই তা সে প্রকাশিত বা অপ্রকাশিতই হোক জ্ঞাতসারে/অজ্ঞাতসারে কিছু দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয়। যথার্থ শিক্ষার অভাব অজ্ঞাতসারে মানুষকে দাবড়িয়ে নিয়ে যায় ধোঁয়াশার চাদরে। যদি সে প্রকৃত সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ছুঁতে পারে তাহলে সাযুস্য করে নেয় জীবন এবং চলার পথে বাধ্যবাধকতা। শিশির আজম অপ্রথানুগত মৌল চিন্তার খোঁজে পাঠককে ছুঁড়ে ফেলেছেন নিরব উঠোনের খাপছাড়া আলোয়। জেগে ওঠে তৃতীয় চোখের জ্বলুনি। এই জ্বলুনি সম্বল করে এগিয়ে যাওয়া মাইলের পর মাইল ব্যর্থ বোঁটা থেকে ঝরে পড়া মূল্যবান সময়ের শিকড় খুঁজে বের করে আনতে। তার খুঁজে পাওয়া ঋদ্ধ আরো প্রাজ্ঞ, প্রতিজ্ঞ ও প্রতিধ্বনিময়। হৃদকেন্দ্র থেকে উঠে আসে ধবল প্রজাপতি তারকা।
ব্যাঙ্গ উপহাসের অনুষঙ্গ। ব্যাঙ্গের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষিতকে তুলে ধরে তার ভিতরকার ফাঁপা প্রণোদনা সাজানো শোকেস থেকে বের করে সাহসী ক্ষীপ্রতায় তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন আপনদাহ, এটিকে শৈল্পিকতার আবরণে বিন্যাসে বাস্তবতার বর্ণিলতার সমন্বয়ে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আবেগের সুনিয়ন্ত্রিত সাজানো স্তর। কবিতা ব্যক্তির আপন চিন্তার থরে থরে সাজানো মননের বহিঃপ্রকাশ। তার সাজানো পদাবলী থেকে পরিচয় ঘটে তার ভাবনার অর্ন্তজগতের। কবি শিশির আজম শিল্পিত ক্রোধকে তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। চিকন সুতোর পরতে পরতে বানিয়েছেন বাঁকা শ্লেষ, পরিহাসবোধ, তুলে ধরেছেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রাগী ইঙ্গিত।
‘নায়িকার নিচের দিক সম্পূর্ণ খোলা থাকবে, সমস্ত কাহিনী জুড়ে; বুর্জোয়া, খুঁদে বুর্জোয়া
বা মধ্যবিত্তের গমন-নির্গমন আদৌ বাঁধাগ্রস্থ হবেনা
...দেয়াল ছিল, দেয়ালের প্রতিধ্বনির আবেশ
...শবযাত্রায় কালো পোশাক ও গাম্ভীর্য বাড়ছে...
নাটকীয়তা ছাড়াই, প্রয়োজনে নায়ীকার সংখ্যা বাড়ানো হবে
যে পুংলিঙ্গগুলো অতি বৃহৎ সেগুলোর সঠিক মাপ ও শক্তিমত্তা যেন পরীক্ষা হয়ে যায়
...সিনেমায় পুংলিঙ্গ দেখানোর নিয়ম নেই...
...তবে এটাই হবে পৃথিবীর শেষ সিনেমা...’
[মানবজাতির শেষ শিল্পকর্ম/ পৃষ্ঠা-৩৮]
পরিব্রাজন শেষ হয়ে গেলে সকল জীবই আবার ফিরে আসে আপন নিলয়ে। নাড়ির টানকে অস্বীকার করা যায় না, যতই থাকুক বাইরের আস্ফালন। উল্কাজগতের বস্তুকণাসমূহ কিশোরীর আঁধার খোপায় আবার সংঘাতে লিপ্ত হবে। অতিসর্তকে অবচেতনে স্নায়ুতন্ত্রে জেগে ওঠে জীবিত ক্ষতের প্রাচীন মাদকতা।

দেয়ালে লেখা কবিতা । শিশির আজম। প্রকাশক: সতত প্রকাশনী। প্রকাশকাল: ফেবু্রয়ারি ২০০৮। প্রচ্ছদ: আবদুস শাকুর শাহ। পৃষ্ঠা: ৬২। মূল্য: ৪০ টাকা।

সোনারোদ্দুর



রাখাইন কুমারী

মনির ইউসুফ


চইদজ্জার ঘাটে সোনালিমা রোদের বাহার। বিকেলের সোনাঝরা রোদের মিহি মায়ায় প্রগৈতিহাসিক ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ। মানুষগুলো আজিও আদিম। শরতের রি রি বাতাসে কন কনে ঠাণ্ডা আমেজ, এই বাতাসে ডানা মেলে দিয়েছে একঝাঁক রাখাইন কুমারী। গ্রামটা দরিয়ার তীরবর্তী। সাগরের লোনাজল, প্যারাবন মাছ, সতেজ হাওয়া আর নীলাকাশের সাথে এদের জীবন যাপন।
দরিয়ার ঢেউ ভেঙে ভেঙে চরজাগা এই চরাভূমিগুলোতে কখন থেকে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারেনা। অনুমানই মনুষ্য বসবাসের ইতিহাসের নিয়তি। উপকূলের সবটা বেড়িবাঁধ জুড়ে নাপ্পি শুকানো হয়। পাশে দরিয়ার বিশাল চারণভূমি, প্যারাবন। বাতাসে নাপ্পির ঘ্রাণ, লোনা সতেজ। স্থানীয় রাখাইনরা সারি সারি তলয়ের উপর সারা রাস্তায় নাপ্পি শুকাতে দিয়েছে। মঙ স্থানীয় দরিদ্র রাখাইন জেলে। এই তল্লাটের বেশিরভাগ মানুষ হয় জেলে নয় বহদ্দার। গভীর সাগরে মাছধরা এদের অন্যতম পেশা।
মঙ সারাদিন কাজ করে। সারারাত মদ খেয়ে নাচে আর বউয়ের সাথে ফূর্তি করে। মদ রাখাইনদের প্রিয় পানীয়। আর চন্দন দিয়ে সারা মুখে রেখাঙ্কন রাখাইন তরুণ-তরুণীদের প্রিয় প্রসাধনী। মঙের দুই মেয়ে। সব রাখাইনদের মতো তারাও নাপ্পি তৈরী করে।
যখন প্রথম রাখাইন পাড়াতে যাওয়া শুরু করি, মঙের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার স্থানীয় বাঙালি তরুণ বন্ধু জয়নাল। জয়নালের সাথে রাখাইনদের খুবই মাখামাখি সম্পর্ক। একসাথে মদ্যপান, মাছধরা, সময় কাটানো ইত্যাদি সব মিলিয়ে একটা সুন্দর সম্পর্ক। আমরা মঙের জলটঙ বাড়ির একটা কামরায় বসে কথা বলছিলাম। মঙের মেয়ে দুটো আর একটি ছেলের দুধে আলতা বরন। একে একে সবার সাথে পরিচয় হলো।
মঙের মেয়ে দুটো লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে আমার সাথে আলাপ শুরু করলো। বাঙালি রক্ষণশীলদের মত এদের পর্দার ব্যাপার নেই। কেউই ওড়না পরেনি। বুকে একটা বাজু, কোমরে থামি। তবু শরীরের কোথাও কোন আড়ষ্টতার ছাপ নেই। আদিম অকৃত্রিম এদের জীবন যাপন। এদের সংস্কৃতিটাই এমন। ছেলেরা মেয়েরা মুখে চন্দন মেখে সারাপাড়া ঘুরে বেড়ায়। চন্দন মেখে বাজুপরা মেয়েগুলোর বাংলা উচ্চারণের ধরণ শুনে হাসি পাচ্ছিল। আর মেয়েগুলোর চোখে চোখ পড়তেই আমার মাঝে একটা শিহরণ গড়িয়ে যেতে লাগলো। চোখে চোখে সঞ্চারিত হতে লাগলো আলো। মেয়েগুলোর কুসুম-দেহ বাতাসে দোল খায়। হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।
বাঙালি কোন তরুণ সাধারণত এপাড়ায় আসে মদ খেতে। মঙের ছোটমেয়েটি জয়নালের সাথে রাখাইন ভাষায় বাক্যালাপ করলো। মাথামুন্ডু তার কিছুই বুঝিনি। জয়নাল পরে বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে বলে। আমি যে মদ্যপান করিনা শুনে মেয়েটি অবাক হয়েছে। কোন তরুণ ছেলে-ছোকড়া মদ্যপান করেনা মেয়েটি নাকি এই প্রথম জানলো। আমাদের বসতে বলে মঙ আবার নাপ্পি তৈরী করতে নেমে গেলো। সাগরের ছোট ছোট মাছ যে-গুলোর বাজার দর কম সে সমস্ত বিঙি মাছগুলো দিয়ে নাপ্পি বানানো হয়। একটা কাঠের বাক্সে মাছগুলো রেখে চাইন্দা দিয়ে ঘষা দিয়ে দিয়ে এবং তা দলা দলা করে তলাইতে শকাইয়ে শুকনো করে একটা ঔষধ জাতীয় দ্রবণ দিয়ে পাহাড় থেকে কাঁচা গোলপাতা এনে তরমুজের মত গোল করে থরে থরে সাজয়ে রাখা হয়। পরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়।
এদের একটা বাড়ির সাথে আরেকটা বাড়ির দূরত্ব খুবই কম। সবটা দোতলা। নিচে কাপড়, সাগরে মাছধরার জাল ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের জিনিসপত্রে ঠাসা, উপরে শোবার ঘর। সাগরের জল থেকে বাঁচার জন্য এ ধরণের ব্যবস্থা।
রাখাইনপাড়া যাওয়া আমার কাছে নেশা হয়ে যায়। প্রতিদিন ঘুরে আসি রাখাইন পাড়া, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ, লবণাক্ত ঐ প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবী। যেতে যেতে অনেক রাখাইনের সাথে ঘনিষ্টতা হয়। মঙের ছোট মেয়ে উমের সাথে নিবিঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনে চোখের ভাষায়, চোখে চোখে ঘনিষ্ট হই। চোখে চোখে পান করি সাগরের লোনাজল। মঙের সাথেও আমার সম্পর্কটা গড়ে ওঠে স্নেহের। মনে মনে ভাবি উমেকে স্বপ্নের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেবো। সেইদিন কবে আসবে, আমরা দুজন দু-হৃদয়ের ডানা মেলে দেবো সাগরের এই প্রান্তে।
নাপ্পি শুকানো, মাছধরা, ভাত যোগাড় করা এসব করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে মঙ। নাপ্পির কাজ করতে করতে রাত হয়ে যায় মঙের। আকাশে চাঁদের ফুটন্ত টগবগে জোছনা। পাশে সাগরে ঢক ঢক করে বাজছে বড়বোট, জালিবোট, বড়শিবোট। জেলেরা মাছধরে ফিরে আসছে উপকূলে। বোটগুলো নোঙর করতেই মাছকামলাদের মধ্যে একটা হৈচৈ পড়ে যায়, সবাই হারাঙ নিয়ে বোট থেকে মাছ নামিয়ে একটা তলইতে স্তুপ করে রাখে।
এদিকে মাছক্রেতা ফাঁড়িয়া ব্যবসায়ীরা মাছের দর হাঁকাচ্ছে। আজকাল এমন হয়ে গেছে, সাগর থেকে মাছ আসার পর পটাপট কিনে ফেলে ফাড়িয়া ব্যবসায়ীরা। এতে স্থানীয় নাপ্পি তৈরী করা রাখাইনদের ক্ষতি হয় বেশী। এখন তারা বর্তমান চড়াদরে মাছ কিনতে পারেনা। অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, আগে যে মাছের কেজি বিশ ত্রিশ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সে মাছ একশো দেড়শো টাকাতেও পাওয়া যায়না। এতে দরিদ্র রাখাইনরা মার খাচ্ছে বেশি। তারা নাপ্পি তৈরী করতে হিমশিম খাচ্ছে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছের দর শোনে মঙ। না তারপক্ষে এদরে মাছ কেনা কোনভাবেই সম্ভব নয়। মনে মনে নিজের প্রতি খুবই বিরক্ত হয় মঙ। সে নাপ্পিগুলো বস্তাতে ভরে আর রাখাইন ভাষায় গান ধরে। ঘরে গিয়ে লুট মদ খায়, আর নাচে। আর হু-হু করে ডাক দেয়। চিৎকার করে। হয়তো মঙ তার কষ্ট ভুলতে ভণিতা করে, হয়তো তার স্বভাব-সুলভ বিনোদন। মঙের গান আর নৃত্যে রাখাইন পাড়া জেগে ওঠে। মঙের ছোট্ট উঠোনটা ভরে যায় রাখাইন বৃদ্ধ নর-নারী, তরুণ-তরুণীতে। যুথচারী নৃত্যের তালে তালে হেলে দুলে এরা মদ্যপান করে আর তাদের নারীরা লে-লে বলে একসঙ্গে গর্জে ওঠে। এ এক অন্যজগত। রাখাইন ভাষার গান না বুঝতে পারলেও সুর খুবই করুণ ও মধুর। স্থানীয় বাঙালি বন্ধুটি আমাকে বুঝিয়ে দিলো, যার অর্থ দাঁড়ায়:
আমাদের ভাষা আছে নদী আছে সাগর আছে
জমি নাই, ভিটা নাই
আমাদের স্বপ্ন আছে স্মৃতি আছে নারী আছে
আমাদের স্থায়ী কোন ঠিকানা নাই
আমরা অসহায়, আমাদের অসহায় করে রাখা হয়েছে
সৃষ্টির কেউ আমাদের পক্ষে নাই।
গভীর মর্মবেদনা এবং না পাওয়ার হাহাকারে ভারা রাখাইনদের জীবন। জয়নালকে জিজ্ঞেস করি, এরা যে ভিটেমাটিতে থাকে তা-কি ওদের নয়? জয়নাল জানালো, এগুলো স্থানীয় জমিদার চৌধুরী মোস্তাকের। এরা হাজার বছর এস্থানে বসত করেও এই ভিটেমাটি নিজেদের করতে পারেনি! সরকারী কোন আইনও নেই এদের ভিটেমাটিগুলো ওদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়। এরা যে থাকতে পারছে- এটাই ওরা অনেক বড় মনে করে। আমি বল্লাম, তাইতো এরা গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করছে। প্রায় একঘন্টা নাচলো তালে তালে এরা সবাই নারী ও পুরুষ। নাচতে নাচতে সবাই ক্লান্ত যখন, মদের নেশা, নাচের ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু শরীরে সবাই একে একে যে যার ঘরে চলে গেলো।
এত রাতে আমরা ফিরবো কি করে! মঙের বাড়িতে সে রাত আমরা রয়েই গেলাম। জয়নালও পান করেছে বাংলাটা। সবাই কেমন ক্লান্ত ও নেশাতুর হয়ে পড়েছে। কেউ রারান্দায় কেউ ঘরে ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমাতে পারছিনা কেবল আমি ও উমে। জোছনার শেষ প্রহরের আলো কি মায়াময় স্বপ্ন নামাচ্ছে? মায়াময় স্বপ্নময় জোছনার ভিতর উমে আমার পাশে এসে বসলো। বললো, তুমি রোজ রোজ আমাদের বাড়িতে আসো কেনো বলতো? করুণ ও দুঃখীভাব উমের চোখেমুখে। আমি শুধু বললাম, জানিনা তো! উমে বলে, সত্যি করে বলো! তা-না হলে আমি কি করবো তুমি বুঝতেও পারবে না! আমি উত্তর দেবার আগে আগেই উমে আবার বলতে শুরু করলো,- ‘আমি জানি তুমি আমার লোভেই প্রতিদিন এখানে আসো। তোমার চোখের ভাষা আমি আগেই পড়ে নিয়েছি! কেনো তুমি আমাকে এমন করে ভালোবাসলে? তোমার জাত আমার জাত আলাদা, বাবা আমাদের কোনদিন মেনে নেবেনা। কোনদিনই মেনে নেবেনা। একমাত্র উপায় তোমার সাথে চলে যাওয়া, কিন্তু আমি তাও করতে পারবোনা।’ কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে উমে, কাঁদতে থাকে, আমার সারা শরীরে নিঃশ্বাস গড়িয়ে দ্যায়, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সুখ কুড়িয়ে নেয়। সাগরের তরঙ্গের উপর দিয়ে জোছনা আর বাতাস ফোঁপাতে ফোঁপাতে গড়িয়ে যায়। নাপ্পির গন্ধে ভরে যায় আমার প্রাণ। উমের চুলে বিলি কেটে দিই। উমের কান্না আমাকে বিলোলিত করে, আমি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। সূর্যের থালাটা লাল হয়ে ওঠে। রোদে ঝলমল করে সকাল। হলুদ সকালে স্বপ্নের মতো মনে হয় উমেকে। রাতের কান্না থেমে গেছে। একরাশ ভালোবাসা ও হাজার প্রশ্নগুলো আমাদের অনুভূতির ডানায় উড়ে উড়ে যায়।


একটি নতুন পেন কেনার পর

সরসিজ আলীম


শিল্পের উদ্রেক: একজন পরিব্রাজককে জানতে পারি, চিনতে পারি, বুঝতে পারি। তিনি মনের মধ্যে দূরের ডাক শুনবেন। বুকের ভেতর চিনচিনে সাড়া বোধ করবেন। কুলকুল স্বরে সাড়াটি গড়াতে শুরু করবে। গড়গড় চলতে শুরু করবে। ছলাত্ছল দৌড়তে শুরু করবে।

একজন পরিব্রাজকের দূর গন্তব্য নির্দ্দিষ্ট অথবা নির্দ্দিষ্ট নয়। যদি নির্দ্দিষ্ট হয়, তবে আপাত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেখতে পাবেন, তার আপাত গন্তব্য এলোমেলো। যে সময়টা ধরে তিনি এসেছেন, সে সময় তিনি পার করে ফেলেছেন, বা সময়ই এখনো সাজগোজ করে উঠতে পারেনি, বা সময়ের আনুষ্ঠানিক সূচী-ছকই পাল্টে গেছে। তবে তিনি আশাহত হবেন না। এই আশাহত না হওয়ার ভেতরে একটা শিল্পের উদ্রেক চলতে শুরু করে। আবার অনির্দ্দিষ্ট গন্তব্য হলেও অনেক সময় হঠাত্ লাফ দিয়ে এসে সামনে উপস্থিত হতে পারে অভিনবত্ব। তখন মনে হতে পারে এটাই আমার উপস্থিত গন্তব্য। এরজন্যই ঘর থেকে বের হতে পেরেছি। মূগ্ধতায় গড়াগড়ি চলে আকাশ-ঘুড়ি-দেহ-মন-কানন| একজন কেতা-পরিব্রাজক তার অবস্থান হতে কিছু না কিছু তুলে আনবেনই। এই তুলে আনবেনটাই একটা শিল্পসম্ভাবনার দিকে ধাবিত হবে।

কবিতা এমন: বাংলা কবিতার পূর্বসূরী যেমন বলা যায়- চর্যাপদ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে মধুসূদন দত্ত হয়ে জীবনানন্দ দাশ হয়ে জসিম উদ্দিন হয়ে শামসুর রাহমান হয়ে উত্তরসূরীদের কালে এসে ঠেকেছে। আমরা একটা সমৃদ্ধ কাব্যধারার উত্তরাধিকারী হয়েছি। সমৃদ্ধ কাব্যধারার পাঠক হিসেবেই আমাদেরকে নতুন কাব্যনির্মানে সচেষ্ট হতে হয়। আর এ প্রসঙ্গে কবি প্রভাত চৌধুরীর উত্তর পর্বের কবিতা থেকে ‘কবিতা লেখালেখি’ কবিতাংশ উদ্ধৃত করা যায়:
‘একটি নতুন পেন কেনার পর তাকে কবিতা লেখায় দীক্ষিত
করে তুলতে প্রথমেই শান্তিনিকেতনে নিয়ে যেতে হয়, যে
বটগাছটির তলায় বেদীতে বসে রবীন্দ্রনাথ সূর্যাস্ত দেখতেন
সেখানকার সূর্যাস্ত না দেখলে কোন পেনই কবিতা লেখার
যোগ্য হতে পারে না,’
অবশ্যই পূর্বসূরীদের পাঠ করে নিমগ্নতা শিখতে হয়। এই নিমগ্নতা দিয়ে সুদূরকে রচনা করা চলতে থাকে।

আমাদের দৃশ্যমানতার বাইরের দৃশ্যমানতাকে আঁকাআঁকির সহজ ও সাবলীল মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। আর এটা আঁকতে গিয়ে অবশ্যই বিমূর্ততা কোন অজুহাত হতে পারে না। এটাকে অবশ্যই মুর্ত করে তোলা সম্ভব। সেটা উচ্চমানের মৌলিক সাহিত্যেই সম্ভব। তাই বিমূর্ততার অজুহাত দিয়ে শব্দের খেলায় মেতে কবিতা বলা চললেও কাব্যপ্রসিদ্ধির শর্টকার্ট রাস্তা বলা যেতে পারে। আর মনের ভেতর যে বিষয়গুলো খুবই আলোড়িত করে; সেটা রাজনীতি হতে পারে, সংঘাত হতে পারে, মানুষকে সংগঠিত করার দায় হতে পারে, উল্লাস হতে পারে, প্রতিবাদ হতে পারে, সুখানুভূতি হতে পারে, রোদন-ক্ষোভ-হতাশা হতে পারে, এই বিষয়গুলো খুবই তাজা ও সতেজ করে রূপায়িত করাটাই কবিতার বিষয়। রূপায়নটা চলতে থাকবে তাবৎ বিশ্বের তাবৎ মানবের ব্যাঞ্জনায়।

কবিতার প্রাসঙ্গিকতায় আমার একটা কবিতা নিবেদন করতে পারি:

কবিতা এমন

খড়ের মাচার তলে পা ছড়িয়ে গল্প করতে থাকা ইঁদুরের যৌনগন্ধগুলো বৃষ্টির দিনে অবিরাম বয়ে চলা গড়াতে গড়াতে ভেসে বেড়ায় সারা মাঠ;- বাদল দিনের এমনই ব্যাখ্যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

খুব সকালে মদ্দামেয়ে খড়ের মাচার আড়ালে ব’সে মুতের গন্ধে ভাসিয়ে দ্যায় ঘুমিয়ে পড়া ইঁদুরের গর্তগুলো, আর ইঁদুরগুলো দৌড়তে থাকে, রাজহাঁসের একঝাঁকের পিছে পিছে গিয়ে দৌড়গুলো থমকে যায় দিঘির পাড়ে, আর দেখতে থাকে হংসমিথুনের ভাসতে ভাসতে ডুবে যাওয়া, আর ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠা যৌনগন্ধগুলো;- একটি সকালকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন জীবনানন্দ দাশ।

খড়ের মাচার তলের ইঁদুরের বিনিদ্র যৌনগন্ধগুলো জোছনা বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে বৃক্ষদের পল্লবে মাথা রেখে দুলতে থাকে সারারাত, দুলতে দেখা যাবেই, আর দুলতে থাকার জন্য হাওয়া বইতে হবেই এমন কোন কথা নেই;- জোছনারাতের এমনই ব্যাখ্যা করেছেন প্রভাত চৌধুরী।

আর কবিতা পড়তে পড়তে সারারাতের বিনিদ্রসুখ বইয়ের পাতা থেকে ঝ’রে ঘর থেকে বেরিয়ে খড়ের মাচায় গিয়ে দোল খাচ্ছেন শামসুর রাহমান, আর রৌদ্রের গন্ধের ভেতর বাঁশি শুনছে বাংলাদেশ।